শবে কদর কি? কী ঘটেছিল এই কদরের রাতে? শবে কদরের ফজিলত ও আমল


আসসালামুআলাইকুম বন্ধুরা, কেমন আছেন সবাই? আজকের এই আর্টিকেলটিতে আলোচনা করা হয়েছে  শবে কদরের ফজিলত ও আমল সম্পর্কে। এ থেকে আপনি জানতে পারবেন শবে কদর কি? শবে কদর বা লাইলাতুল কদরের বিস্ময়কর ইতিহাস। কি ঘটেছিল এই কদরের রাতে? যে ঘটনা জানলে আপনি অবাক হবেন তাই আর্টিকেলটি শেষ পর্যন্ত পড়ার অনুরোধ থাকলো। 

শবে কদর কি

মহিমান্বিত লাইলাতুল কদর শবে কদর এই উম্মতের জন্য আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের এক বিরাট নিয়ামত। কদরের রাত পাপ মুক্তির রাত, জাহান্নাম থেকে বাঁচার রাত, জান্নাতে যাওয়ার অপূর্ব সুযোগ। লাইলাতুল কদর কে উর্দু ও ফার্সিতে শবে কদর বলা হয়। শবে অর্থ রাত্র আর কদর অর্থ সম্মান সুতরাং শবে কদর অর্থ সম্মানের রাত্র। আবার কদরের অন্য অর্থ হচ্ছে তাকদীর। এই শব্দটি ব্যাপক গুরুত্ব বহন করে। অতএব শবে কদরের অনেক গুরুত্ব রয়েছে। এই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আলামীন পূর্ণাঙ্গ একটি সুরা-

সূরা আল কদর নাযিল করেছেন। এই সূরায় আল্লাহ পাক বলেন ''নিশ্চয়ই আমি কোরআন নাজিল করেছি কদরের রাত্রে। আপনি কি জানেন শবে কদর কত বড় জিনিস।'' শবে কদর হাজার মাসের চেয়েও উত্তম। এই রাত্রে ফেরেশতাগণ অবতীর্ণ হন এবং এই রাত্রিতে রুহুল কুদ্দুস অর্থাৎ হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম অবতীর্ণ হন। ফেরেশতাগণ তাদের পরওয়ারদিগারের হুকুমে প্রত্যেক ভালো ও কল্যাণকর বিষয় নিয়ে জমিনের দিকে অবতরণ করেন। এই রাত্রিটি শুরু হতে শেষপর্যন্ত সালাম এবং শান্তির মধ্যে থাকে। এই রাত্রে উল্লিখিত বরকত সমূহ সুবহে সাদিক পর্যন্ত অবস্থান করে।



শবে কদরের নিয়ামত 

কুরআনুল কারীমে শবে কদর কে হাজার মাসের চেয়েও উত্তম বলা হয়েছে। হাজার মাসে ৮৩ বছর ৪ মাস। কতইনা ভাগ্যবান ওই ব্যক্তি যার এই রাত্রে ইবাদত করার তৌফিক হয়ে থাকে। 

কারণ যে ব্যক্তি এই রাত্রিটি ইবাদতের মধ্য দিয়ে কাটিয়ে দিল সে যেন ৮৩ বছর ৪ মাসের বেশি সময় ইবাদতের মধ্যে কাটিয়ে দিল। আর আমাদের এটাও জানা নেই যে এই রাত্রিটি হাজার মাসের চেয়ে কত বেশি উত্তম। যারা এই মোবারক রাতের কদর বুঝেছে তাদের জন্য বাস্তবিক ইহা আল্লাহ তাআলার একটি অপরিসীম নিয়ামত। দূররে মানসুর কিতাবে হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের একটি বাণী এসেছে যে ''আল্লাহ তাআলা শবে কদর আমার উম্মত কে দান করেছেন।'' পূর্ববর্তী উম্মতগণ খেতাব দেওয়া হয়নি। কি কারনে এই উম্মতকে তা দান করা হয়েছে এই ব্যাপারে বিভিন্ন রকম রেওয়ায়েত বর্ণিত আছে। একটি রেওয়ায়েতে আছে যে, একদিন রসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম বনি ইসরাইলের চারজন আবেদের কথা বললেন। যারা ৮০ বছর পর্যন্ত নিরলসভাবে আল্লাহপাকের ইবাদতেরত ছিলেন।


এই সময় এক মুহূর্তের জন্য আল্লাহ পাকের হুকুম এর বরখেলাপ তারা করেননি। উক্ত চারজন আবেদ হলেন হযরত আইয়ুব আলাইহিস সালাম, হযরত যাকারিয়া আলাইহিস সালাম, হযরত খিজকিল আলাইহিস সালাম এবং হযরত ইউসা বিন নুন আলাইহিস সালাম। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের এই কথা শুনে সাহাবায়ে কেরাম খুবই আশ্চর্য এবং বিস্মিত হয়ে বললেন তাদের পক্ষে এত ইবাদত করা সম্ভব নয়। কারণ আখেরি নবীর উম্মত ৬০ থেকে ৭০ বছরের মধ্যে ওফাত বরণ করেন। কাজেই তাদের সমান বয়স না পাওয়ায় এত ইবাদত করা সম্ভব নয়। এর পরিপ্রেক্ষিতে আল্লাহ পাক সূরা আল-কদর নাযিল করেছেন। মোহাদ্দিস ইবনে আবী হাতেম রহমাতুল্লাহ আলাই, তাফসি্রের ইমাম-মুজতাহিদ রহমতুল্লাহি থেকে বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাম একদিন সাহাবায়ে কেরামের বৈঠকে বনি ইসরাইলের এক মুজাহিদের কথা উল্লেখ করেন। তিনি এক হাজার মাস নিরবিচ্ছিন্নভাবে আল্লাহর সাধনায় লিপ্ত ছিলেন। 

এই কথা শুনে সাহাবায়ে কেরামের আফসোস হলো। এক হাজার মাস অর্থাৎ ৮৩ বছর ৪ মাস তো এই যুগের অনেকে জীবনেও পায়না। তাই হযরত মূসা আলাইহিস সালাম এর উম্মত বণি ইসরায়েলের মত এত অধিক সওয়াব লাভের অবকাশও উম্মাতে মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের নেই। সাহাবে কেরামের এই আফসোস অনুশোচনা কালে হযরত জিবরীল আলাইহিস সালাম আল্লাহর পক্ষ থেকে কোরআন মাজিদের সূরা আল কদর নিয়ে হুযুর সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামের কাছে আগমন করেন। তাফসীরে মাআরিফুল কুরআনে ইবনে জারীর রহমতুল্লাআলাই কর্তৃক অপর একটি ঘটনা এভাবে উল্লেখিত হয়েছে, বনি ইসরাইলের জনৈক ইবাদতকারী সমস্ত রাত ইবাদতের মশগুল থাকতেন এবং সকাল হতেই জেহাদের জন্য বের হয়ে যেতেন এবং সারাদিন জেহাদের রত থাকতেন। তিনি এক হাজার মাস এভাবে কাটিয়ে দেন। এই প্রেক্ষিতেই আল্লাহ তাআলা সুরা আল কদর নাজিল করে এই উম্মতের শ্রেষ্ঠ অর্থ প্রদান করেছেন। 

এই থেকে এই কথা স্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে শবে কদর শুধু উম্মতে মুহাম্মদের বৈশিষ্ট্য, শবে কদর কে গোপন রাখার হেকমত, শবে কদর কে গোপন রাখার মধ্যে রয়েছে আল্লাহ তাআলার বিরাট হিকমত ও রহস্য। 

শবে কদরের আমল

প্রত্যেক মূল্যবান বস্তু হাসিল করা যেমন কষ্টসাধ্য ব্যাপার তেমনি আল্লাহর উদ্দেশ্য হলো এই মহামূল্যবান রাতের অনুসন্ধানে বান্দাগণ সাধনা করুক। এক রাতের জন্য অন্তত পবিত্র রমজান মাসের ৩০ টি রাত জাগ্রত থাকুক। মানুষ দুনিয়ার কত তুচ্ছ জিনিসের জন্য কত রাতের নিদ্রা হারাম করে দেয়। কিন্তু হাজার মাসের অধিক মর্যাদা সম্পন্ন একটি রাতের জন্য কিছু কষ্ট স্বীকার করতে পারে না। এই জন্য উচিত হল রমজানের শেষ দশকের প্রতিটি বেজোড় রাত্রে জাগ্রত থেকে কিছু জিকির-আজকার, তাসবিঃ তহলিল, তেলাওয়াত, নফল নামাজ প্রভৃতির মাধ্যমে শবে কদরের ফজিলত অর্জনের চেষ্টা করা।

অন্তত এশা ও ফজরের নামাজের জামাত এ অংশগ্রহণ করা। হাদীসে এসেছে ইশা এবং ফজরের নামাজ জামাতে আদায় করা প্রকারান্তরে সম্পূর্ণ রাত ইবাদত করার সমতুল্য।


শবে কদরের আলামত

হযরতে উবাদা ইবনে সামেত রাদিয়াল্লাহু আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালামকে শবে কদর সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি ইরশাদ করেন, উহার রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে অর্থাৎ ২১ ২৩ ২৫ ২৭ ২৯ তারিখে বা রমজানের শেষ রাত্রে হয়ে থাকে। যে ব্যক্তি জিরো একিনের সাথে সোয়াবের আশায় এই রাত্রে ইবাদতে মশগুল হয় তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। এই রাত্রে অনেক আলামত এর মধ্যে একটি হলো এই রাত্রিটি নির্মল ঝলমলে হবে। নিঝুম নিথর না অধিক গরম না অধিক ঠাণ্ডা বরং মধ্যম ধরনের হবে। চন্দ্রজ্জ্বল রাতের মতো মনে হবে। 

এই রাতে শয়তানের প্রতি তারকা নিক্ষেপ করা হয় না। এর আরো একটি আলামত এই যে, পরদিন সকালে সূর্য কিরণ বিহীন একেবারে গোলাকার পূর্ণিমার চাঁদের মত উদিত হয়। আল্লাহ পাক এই দিনের সূর্যোদয়ের সময় উহার সহিত শয়তানের আত্ম প্রকাশ বন্ধ করে দেয় - দূররে মানসুর আহমেদ এবং বাইহাকী থেকে সংগ্রহীত।


শবে কদরের অনুসন্ধান

শবে কদরের তারিখ নির্ধারিত নেই। তবে অধিকাংশ ওলামায়ে কেরামের মতে পবিত্র রমজান মাসের শেষ দশদিনের বেজোড় রাতগুলোতে শবে কদর কে অনুসন্ধান করতে হয় অর্থাৎ রমজানের ২১ ২৩ ২৫ ২৭ এবং ২৯ তারিখ সমূহের যে কোন এক রাতে শবে কদর ঘটতে পারে। তাই রমজানের শেষ দশ দিন বেজোড় রাত সমূহের মধ্যে লাইলাতুল কদরের তালাশ করতে হয়। রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম আরো ইরশাদ করেন, ''তোমরা লাইলাতুল কদর কে মাহে রমজানের শেষ দশকের বেজোড় রাত্রে তালাস করো'' - সহীহ বুখারী শরীফ থেকে সংগ্রহীত।


শবে কদরের ফজিলত

শবে কদরের ফজিলত সম্পর্কে কোরআনুল কারীমে খুব অল্প কথায় ব্যাপক কথা বলা হয়েছে। শবে কদর হাজার মাসের অপেক্ষা উত্তম। এইখানে কত হাজার মাস অপেক্ষা উত্তম তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। তার পরেও যদি একে কমপক্ষে ১ হাজার মাস ধরা হয় তাহলে হিসাব করলে দেখা যায় যে তার ৮৩ বছর ৪ মাস হয়ে থাকে অর্থাৎ শুধু কদরের একটি রাতের ইবাদত দ্বারা ৮৩ বছর ৪ মাস নিরবিচ্ছিন্নভাবে ইবাদত করার সওয়াব পাওয়া যাবে বলে হাদিস বিশারদগণ বলেছেন। হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহিস সালাম বলেন, ''যদি তোমরা কদরকে আলোকময় পেতে চাও তাহলে লাইলাতুল কদরে জাগ্রত থেকে ইবাদত করো। মিশকাত এবং বাইহাকী গ্রন্থ থেকে সংগ্রহীত- রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যে লোক শবে কদর থেকে বঞ্চিত হয় সে যেন সমগ্র কল্যাণ থেকে পরিপূর্ন বঞ্চিত হলো। ইবনে মাজাহ থেকে সংগ্রহীত - নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহিসসালাম ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি শবে কদরে ঈমানের সহিত এবং সওয়াবের নিয়তে ইবাদতের জন্য দাঁড়ায় তার পেছনের সমস্ত গুনাহ মাফ করে দেওয়া হয়। সহিহ বুখারী ও মুসলিম থেকে সংগ্রহীত - হযরত আনাস রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, একবার রমজান মাস আসলে নবী করিম সাঃ ইরশাদ ফরমান, ''তোমাদের নিকট একটি মাস আসছে। এই মাসে একটি রাত্র আছে যা হাজার মাসের অপেক্ষা উত্তম। যে ব্যক্তি এই রাত্র হতে মাহরম থেকে গেল সে যেন সকল কল্যাণ এবং ভালোই থেকে মাহরম থেকে গেলো আর এই রাত্রের কল্যাণ থেকে কেবল সেই ব্যক্তি মাহরুম থেকে যায় যে প্রকৃতপক্ষেই মহরম ইবনে মাজাহ থেকে সংগ্রহীত।


লাইলাতুল কদর দোয়া

হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- একদা আমি রাসুল (সা) কে জিজ্ঞাসা করলাম ''হে আল্লাহর রাসুল, আমি যদি কদরের রাত সম্পর্কে অবহিত হতে পারি তবে আমি কি দুয়া করবো? তখন রাসুল (সা) আমাকে বললেন- এই দোয়াটি পাঠ করবে "আল্লাহহুম্মা ইন্নাকা আফওন তুহিব্বুল আফুয়া ফা আফুয়ান্নি'' অর্থাৎ হে আল্লাহ আপনি বড় ক্ষমতাশীল, ক্ষমাকে ভালবাসেন, অতএব আমাকে ক্ষমা করে দিন। হযরত সুফিয়ান সাওরি (রহঃ) বলেন- শবে কদরে দোয়া মশগুল থাকা অন্য যেকোন ইবাদতের চেয়ে উত্তম। হযরত ইবনে রজরফ (রাঃ) বলেন- শুধু দোয়া নয় বরং যেমন নামাজ, তিলাওয়াত, দুয়া, মুরাকাবা ইত্যাদি। কেননা নবি করিম (সাঃ) থেকে সবগুলো ইবাদতই বর্ণিত হয়েছে। 

আসুন আমরা শবে কদরের তলাশে লেগে যাই এবং বিভিন্ন ইবাদতের মাধ্যমে এর কদর করি। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আমাদের সঠিক বুঝার তৌফিক দান করুন। আমিন

Post a Comment

Previous Post Next Post