শিলাবৃষ্টি কেন হয়? শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস যেভাবে বুঝবেন

শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

শিলাবৃষ্টি! বর্তমান সময়ের সবচেয়ে আলোচিত এবং অনেক আতঙ্কের বিষয় হলো শীলাবৃষ্টি। প্রতিদিনের খবরের শিরোনাম কিংবা পত্র পত্রিকার পাতা খুললেই শুনতে পাওয়া যায় কোনো না কোনো যায়গায় ব্যাপক শিলাবৃষ্টির মতো ঘটনা ঘটেছে। শুধু তাই নয়, এই শিলাবৃষ্টির তীব্রতা মাঝে মাঝে এতো ব্যাপক আকার ধারণ করে যে মানুষসহ অন্যান্য পশু মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।

আমাদের দেশে বিশেষ করে কালবৈশাখীর সময় অর্থাৎ বৈশাখ মাসে প্রচুর শিলাবৃষ্টি হয়।

শিলাবৃষ্টি কি?

প্রচণ্ড তাপতাহের ফলে নদী-নালা, খাল-বিল , পুকুর-হ্রদ ইত্যাদি হতে পানি বাষ্পীভুত হয়ে উর্ধ্বে উঠে যায়। এই পানি ধীরে ধীরে ঘনীভূত হয়ে মেঘের সৃষ্টি করে। এই মেঘ আবার একপর্যায়ে বায়ুমন্ডলের অত্যন্ত শীতলতর অঞ্চলে পতিত হয় এবং বাষ্পীয় পানির কণাগুলো ধীরে ধীরে বরফে পরিণত হয়। একসময় এই বরফের টুকরো গুলোই মূলত বৃষ্টির সাথে ভুমিতে পতিত হয়। একেই শিলাবৃষ্টি বলে।

শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

সাধারণত গ্রীষ্মকালে অর্থাৎ প্রচন্ড গরমের সময়  শিলাবৃষ্টি হয়। কিন্তু কয়েক বছরের জরিপে দেখা গিয়েছে ফাল্গুন-চৈত্র মাসেই শিলাবৃষ্টির প্রকোপ আকার ধারণ করেছে। আর জলবায়ুর পরিবর্তনের সাথে সাথে এই শিলাবৃষ্টিও তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। আবার অধিক তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণকেও অনেক আবওহাওয়াবিদ গণ প্রাধান্য দিচ্ছেন। গত কয়েক বছরের মতো এ বছরও চৈত্র মাস পড়তে না পড়তেই শিলাবৃষ্টির তান্ডব শুরু হয়েছে। হয়ে গেছে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি। 

শিলাবৃষ্টি কিভাবে সৃষ্টি হয়

আবার কোন স্থানের পরিবেশ খুব উত্তপ্ত হলে সেই স্থানের বাতাস খুব দ্রুত হালকা হয় এবং দ্রুতই উপরের দিকে ধাবিত হয়। একেই মুলত বলা হয়ে থাকে বাতাসের উর্ধ্বমুখী চাপ। 
শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

আর এই উর্ধ্বমুখী চাপের কারণেই প্রচন্ড ঠান্ডা অঞ্চলের সংস্পর্শে বাষ্পের কণাগুলো একে অপের সাথে ঘনীভূত হয়ে মেঘে পরিণত হয়। এই ঘনীভূত মেঘ এক পর্যায়ে আবারও অধিক ঠান্ডা অঞ্চলে সঞ্চালিত হয় এবং ধীরে ধীরে বরফে পরিণত হওয়া শুরু করে। আর এই বৃষ্টিই বরফ আকারে শিলাবৃষ্টিরূপে ভুপৃষ্ঠে পতিত হয়। 
প্রতি বছর অন্তর আমাদের দেশে বৈশাখ মাসে প্রচন্ড গরম অনুভুত হয়। তখন বাতাসের এই উর্ধ্মুখী চাপের কারনেই আবহাওয়া কালবৈশাখীর রুপধারণ করে। আর এই ঝড়ের সময়ই শিলাবৃষ্টির সম্ভাবনা ব্যাপক ভাবে পরিলক্ষিত হয়। 

আবার বৃষ্টির পানির ফোটাগুলো পতিত হওয়ার সময় মাঝপথে আবারও উর্ধ্বমুখী বায়ুচাপের মধ্যে পড়ে যায়। যার ফলে বৃষ্টির ফোটাগুলো নিচে নামার সময় কণাগুলোর কিছু অংশ আবার উপরে উঠতে থাকে এবং এর সাথে আরও ঠান্ডা হতে থাকে।  আবারও ঘনীভূত হওয়ার পর পানির ফোঁটাগুলো আরও ভারী হয়ে আবার নিচে নামতে থাকে এবং আবারও উর্ধ্বমুখী গরম বাতাসের চাপে পড়ে এর কিছু অংশ আবারো উপরের দিকে উঠে যায়।

এভাবে ক্রমান্বয়ে ওঠা নামা করার ফলে একসময় পানির কণাগুলো ছোট ছোট বরফখন্ডে পরিণত হয়। আর এগুলো বেশি ভাড়ী হওয়ার দরুন আর উপরে উঠতে পাড়ে না বিধায় বৃষ্টির সাথে নিচে নেমে আসে। এটাই হচ্ছে শিলাবৃষ্টি। আর এই শিলাবৃষ্টির প্রথম শর্তই হচ্ছে গরম।

শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস

শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস সম্পর্কে সাধারণভাবে বলা যায়, আকাশে যখন অধিক পরিমাণে মেঘ জমা হয় কিংবা মেঘের পরিমাণ ভাড়ী হয় এবং সাথে আচমকা ঠান্ডা অনুভুত হয় তখনি শিলাবৃষ্টি হওয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায়। 

সাধারনত প্রাক-মৌসুমি সময় অর্থাৎ মার্চ মাসের শূরুতেই অথবা কখনো কখনো ফেরুয়ারি মাসেও আবহাওয়া আকাশের কোথাও কোথাও ৩৪ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা থাকে। আর ওই সময়টাতেই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে দখিনা হাওয়া বাতাস বয়ে আসতে পারে। 

এ সময় এই মৌসুমি বায়ু ধীরে ধীরে স্থলভাগের দিকে বয়ে যেতে থাকে। আবার তার সঙ্গে যুক্ত হয় বঙ্গপসাগর থেকে আসা জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস। এই দুইয়ের মিশ্রণে সিলেট থেকে আসা শীতল বাতাস যুক্ত হয়ে মেঘমালা সৃষ্টি করে।
যাকে আবহাওয়া অধিদপ্তর বজ্রমেঘ বলে অবহিত করেছে। 

কোন মেঘ থেকে শিলাবৃষ্টি হয়ে থাকে

এই যুক্ত জলীয়বাষ্পপূর্ণ বাতাস ভু-পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১৮/১৯ কিমি উপরে উঠে এবং আরো ঠান্ডা হয়ে যায় আর অধিক ঘনীভূত হয়ে ছোট ছোট বরফ খন্ডে পরিণত হয়। আবার এই ছোট ছোট বরফ কণা আশে পাশের আরও বরফ খন্ডের সাথে যুক্ত হয়ে বড় শিলাখন্ডে পরিণত হয়। এই শিলাখন্ড যখন বেশ ভাড়ী হয় তখন আর বায়ুমন্ডল এই খন্ডগুলোকে ধরে রাখতে পারে না। আর তখনই এই খন্ডগুলো শিলাবৃষ্টি আকারে ভুমিতে নেমে আসে।

বায়ুমণ্ডলে থাকা শিলাখণ্ডগুলো অবশ্য অনেক বড় আকারে থাকে। মাটিতে ঝরে পড়ার সময় শিলাখণ্ডগুলো একে অন্যের সঙ্গে ঘর্ষণের ফলে ছোট হয়ে যায় এবং তা ছোট ছোট আকারের শিলা হিসেবে নেমে আসে।

আবার স্বাভাবিক অবস্থায় মুহুর্তের মধ্যে ঠান্ডা অনুভূত হওয়াও এক প্রকার শিলাবৃষ্টির পূর্বাভাস এর লক্ষণ।

শিলাবৃষ্টি কেন হয়?

শিলাবৃষ্টির সময় করণীয়

আবহাওয়া অধিদফতর বেশ কিছু পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। 
১। এ সময় খোলা আকাশের নিচে একদমই থাকা যাবে না
২। এ সময় কংক্রিটের ছাউনির নিচে আশ্রয় নিতে হবে। টিনের চালের নিচে আশ্রয় নেওয়া বিপজ্জনক
৩। শিলাবৃষ্টির সময় গাড়িতে থাকলে অথবা গাড়ী চলন্ত অবস্থায় থাকলে গাড়ির স্পীড কমিয়ে নিতে হবে এবং ধীরে চালাতে হবে।
৪। শিলার আঘাতে বিদ্যুতের তার ছিড়ে গেলে সেই তার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকতে হবে অথপবা বিদ্যুত অফিসে জানাতে হবে।
৫। এ সময় পাহারের কোনো গুহায় আশ্র্য নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে । আবার পাহারের আশে পাশে থাকাটাও ঝুকিপূর্ণ কারণ ভূমিধ্বসের আশংকা আছে।


 শিলাবৃষ্টি থেকে মানুষের জীবন রক্ষা পেলেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে তেমন কোনও বড় ব্যবস্থা নেওয়া কঠিন। তবে উন্নত দেশে গ্রিন হাউজ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সফলের সুরক্ষার ব্যবস্থা করা হলেও তা স্বল্প পরিসরের ফসলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। তাছাড়া, আমাদের দেশে গ্রিন হাউজ প্রযুক্তির ব্যবহারও নেই। তাই শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ক্ষতি হলে কৃষককে ক্ষতিপূরণ দেওয়া ছাড়া কোনও বিকল্প সরকারের নেই।

আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, অনেক সময় এই শিলাবৃষ্টি পড়ার গতি ঘণ্টায় ৬০ মাইল পর্যন্ত হতে পারে। তবে সাধারণত ১৫ মিনিটের বেশি শিলাবৃষ্টি হয় না। শিলাবৃষ্টিতে গড়ে একটা শিলার ব্যাস হয় ৫ থেকে ১৫০ মিলিমিটারের মধ্যে। শিলার ব্যাস পৌনে এক ইঞ্চি না হলে শিলাবৃষ্টিতে ক্ষতির সম্ভাবনা তেমন থাকে না। তবে এর চেয়ে বড় ব্যাসের শিলা হলে ব্যাস বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শিলার মাধ্যমে ক্ষতির পরিমাণও বাড়তে থাকে।

Post a Comment

Previous Post Next Post